প্রতি চারজন মানুষের মধ্যে একজন কোনো না কোনো প্রকার চোখের অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় ভুগে থাকেন। এটা খুবই সাধারণ অসুখ, তবে ছোঁয়াচে নয়। অ্যালার্জিজনিত সমস্যা সাধারণত নির্মূল করা যায় না। তবে প্রতিরোধ করা যায়। কাজটা কিছুটা কঠিন যদিও।
অ্যালার্জি কী?
শরীরের এক ধরনের প্রতিরোধব্যবস্থার কারণেই অ্যালার্জি হয়। কোনো জিনিসের প্রতি শরীরের অতি সংবেদনশীলতা থাকলে ওই বস্তু বা জিনিস শরীরের সংস্পর্শে এলেই অতিদ্রুত লাল হয়ে যায়, চুলকায়, ফুলে যায়, পানি পড়ে ইত্যাদি। যখন অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী বস্তু চোখের সংস্পর্শে আসে তখন চোখেও একই প্রতিক্রিয়া হয়। একে চোখের অ্যালার্জি বা কনজাংটিভাইটিস বলা হয়। অনেকে আবার চোখের অ্যালার্জিকে অন্য অসুখ বলে ভুল করেন।
কী কী দিয়ে অ্যালার্জি হয়?
যেসব পদার্থ দিয়ে অ্যালার্জি হয় তাদের বলা অ্যালার্জেন। যেমন-
* খাবার : ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ, গরুর মাংস, ডিম, পালংশাক, পুঁইশাক ইত্যাদি।
* চোখে ব্যবহার্য প্রসাধনী সামগ্রী।
* উদ্ভিদ-ফুলের রেণু, ধুলাবালি, পোকামাকড় ইত্যাদির চোখে প্রবেশ।
* ওষুধে ব্যবহৃত প্রিজারভেটিভ ও ওষুধের পার্শ্ব- প্রতিক্রিয়া।
অ্যালার্জির প্রকার
সাধারণত চোখে ছয় ধরনের অ্যালার্জি হতে দেখা যায়।
* সিজনাল অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস
* পেরেনিয়াল অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস
* ভারনাল কেরাটোকনজাংটিভাইটিস
* অ্যাটাপিক কেরাটোকনজাংটিভাইটিস
* জায়ান্ট প্যাপিলারি কনজাংটিভাইটিস
* কন্ট্যাক্ট অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস
সিজনাল অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস : সবচেয়ে বেশি হয়। বিশেষ বিশেষ ঋতুতে এর প্রকোপ বাড়ে। যেমন, শীতের শেষে। বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফুলের রেণু, ধুলাবালি ইত্যাদি অ্যালার্জেন চোখ ও নাকের সংস্পর্শে এলেই চুলকানি হয়, চোখ লাল হয়ে যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চোখ ফুলে যায়, নাক দিয়ে সর্দি ঝরে, হাঁচি-কাশি হয়, নাকবন্ধভাব হয়। অনেক সময় জ্বরও থাকে।
যাদের এই অ্যালার্জি বেশি হয়, তাদের চোখের চারপাশে কালো দাগ পড়ে যায়।
পেরেনিয়াল অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস : সারা বছর ধরেই এ রোগটি কমবেশি হতে দেখা যায়। সাধারণত লেপ, তোশক, কাঁথা ইত্যাদি থেকে চোখের এই অ্যালার্জি হয়ে থাকে। লক্ষণ কমবেশি সিজনাল কনজাংটিভাইটিসের মতোই।
ভারনাল কেরাটোকনজাংটিভাইটিস : শীতের শেষের দিকে, ফেব্রুয়ারি-মার্চে, রোগটি বেশি হয়। এতে সাধারণত ছোটরা বেশি আক্রান্ত হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমতে থাকে। রোগটি খুব কষ্টকর। আক্রান্ত হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। শতকরা তিনজন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। কোনো কোনো সময় এ রোগটি তীব্র আকার ধারণ করে। ঠিকমতো চিকিৎসা না করলে চোখের মণিতে ক্ষত হতে পারে। মণি ঘোলা হয়ে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে। এ রোগে যারা আক্রান্ত হন তাদের অনেকের আবার হাঁপানি, চর্মরোগ ইত্যাদি থাকে। নিয়মিত চিকিৎসা করা জরুরি। এ রোগে লক্ষণ হিসেবে চোখে চুলকানি, চোখ দিয়ে বেশি পানি ঝরা, চোখের ভেতরে কিছু আটকে থাকার অনুভূতি, আলোর দিকে তাকাতে অসুবিধা ইত্যাদি হতে পারে।
অ্যাটপিক কেরাটোকনজাংটিভাইটিস : সাধারণত বয়স্ক মানুষ এতে বেশি আক্রান্ত হয়। আগে থেকেই যাদের ত্বকের প্রদাহ বা ডার্মাটাইটিস থাকে তাদের রোগটি হওয়ার ঝুঁকি বেশি। সারা বছরই রোগটি হতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় চুলকায়, চোখ জ্বলে, লাল হয়ে যায়, ঘুম থেকে উঠলে চোখের কোণে ময়লা জমে থাকে ও চোখ খুলতে অসুবিধা হয়।
যথাসময়ে চিকিৎসা না করা হলে, চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কন্ট্যাক্ট অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস : সাধারণত যারা চোখে কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করেন তাদের বেশি হয়। এ ক্ষেত্রে চোখ লাল হয়, চুলকায়, লেন্স পরলে অসুবিধাবোধ হয়, চোখ থেকে ঘন তরল ঝরে।
জায়ান্ট প্যাপিলারি কনজাংটিভাইটিস : কন্ট্যাক্ট অ্যালার্জিরই একটি মারাত্মক ধরন এটি। এ ক্ষেত্রে চোখ চুলকায়, চোখ ফুলে যায়, পানি ঝরে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়, সব সময় মনে হয় চোখে কিছু আটকে আছে, চোখ থেকে মিউকাস ঝরে।
যাদের বেশি হয়
পারিবারিকভাবে যাদের হাঁপানি, চর্মরোগ, সর্দিজ্বর ইত্যাদি বেশি হওয়ার ইতিহাস থাকে তারা অন্যদের চেয়ে বেশি মাত্রায় চোখের অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় ভোগে। তবে চোখের কোনো কোনো অসুখও অনেক সময় অ্যালার্জি বলে মনে হতে পারে। এ ধরনের অসুখের মধ্যে আছে-চোখ ওঠা, আঘাতজনিত চোখের প্রদাহ ইত্যাদি।
চিকিৎসা
চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই ভালো। এ জন্য-
* অ্যালার্জি উদ্রেককারী বস্তু থেকে দূরে থাকতে হবে
* চোখে সানগ্লাস বা রোদচশমা ব্যবহার করতে হবে।
* কোনো কিছুতে হাইপারসেনসিটিভিটি বা অতিসংবেদনশীলতা হলে তার চিকিৎসা করাতে হবে।
আক্রান্ত হলে অনেক ধরনের ওষুধ আছে। স্বল্পমেয়াদি চিকিৎসা হিসাবে সাধারণত চোখের ড্রপ ও অ্যালার্জিপ্রতিরোধী ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এতে ভালো না হলে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। এগুলোর মধ্যে আছে অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ, মাস্টসেল স্টাবিলাইজার, স্টেরয়েড ইত্যাদি। কখনো কখনো চোখের কর্নিয়া ঠিক রাখতে চোখের কৃত্রিম পানি ড্রপ হিসেবে নিয়মিত দিতে হয়। নাকবন্ধভাব থাকলে ডিকনজাস্ট্যান্ট (নাকবন্ধভাব দূর করতে যে ওষুধ ব্যবহৃত হয়) দিতে হয়। তবে আগে থেকেই যাদের চোখের অসুখ, যেমন গ্লুকোমা, আছে তাদের ক্ষেত্রে ডিকনজাস্ট্যান্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় চোখে ব্যথার অনুভূতি কমানোর জন্য পেইনকিলার ড্রপও ব্যবহার করা হয়।
যাদের চোখের অ্যালার্জি বারবার হয়, তাদের ক্ষেত্রে কর্টিকোস্টেরয়েডজাতীয় চোখের ড্রপ ব্যবহার করতে হতে পারে। তবে এ ধরনের ওষুধের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে ইনফেকশন, গ্লুকোমা ও ছানি হতে পারে।
চোখের অ্যালার্জির পরিণতি
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সারা জীবন অ্যালার্জির সমস্যা হতে দেখা যায়। তবে ভারনাল কেরাটোকনজাংটিভাইটিসে শিশু বয়সে যারা আক্রান্ত হয়, বয়স বাড়লে তা সেরে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে চোখের অ্যালার্জির কারণে ওপরের পাতা ঝুলে যেতে পারে। চোখের কর্নিয়ায় ক্ষত হয়ে ঘোলা হয়ে দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে।
অনেকেই চোখে অ্যালার্জি হলে স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। এতে অ্যালার্জি সেরে যায়; কিন্তু চোখের অন্য অসুখ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। যেমন, গ্লুকোমা।
তাই যাদের কিছুদিন পরপরই অ্যালার্জি হয় তাদের উচিত চোখের ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা ও ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ ব্যবহার করা।