এক বিনিয়োগকারীর কান্না ও শেয়ারবাজারের মূল্যস্তর - FeniOnline24 - Feni First Online Radio Station

FeniOnline24 - Feni First Online Radio Station

FeniOnline24 a live online Radio station from feni.

Feni Online 24 Radio Station

News Update

Feni online 24 radio station

শনিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২১

এক বিনিয়োগকারীর কান্না ও শেয়ারবাজারের মূল্যস্তর

চৈত্রের তপ্ত দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীরে অফিস ঢুকছি। এ করোনাকালে অফিসে প্রবেশের আগে যুক্ত হয়েছে কিছু রুটিন কাজ। হাতে স্যানিটাইজার মাখা, শরীরের তাপমাত্রা মাপা। এ মাখামাখি আর মাপামাপি শেষে অপেক্ষা লিফটের জন্য। অভ্যর্থনা স্থানে নিয়োজিত সহকর্মী বললেন, একজন লোক আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।

নিরাপত্তাকর্মীর কথা শেষ হওয়ার আগেই সামনে এসে দাঁড়াল মাঝবয়সী এক লোক। মুখে মাস্ক, দেখতে লম্বা চওড়া। নিজের পরিচয়ই দিতে পারছেন না কান্নার তোড়ে। কী নিয়ে কথা বলবেন জানতে চাইলে উত্তর দেওয়ার আগে বেশ কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন। খানিক সময়টুকুতেই একদিকে গড়িয়ে পড়ছে চোখের জল, অন্যদিকে বুক ফেটে বেরোচ্ছে দীর্ঘ নিশ্বাস।

মাস্কটা মুখ থেকে সরিয়ে থুতনিতে নামানোর চেষ্টা করলেন। তাতে বাধা দিলাম। অদৃশ্য ভাইরাস–আতঙ্কে বারবার অনুরোধ করলাম, একটু দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলুন। কে শোনে সে কথা। পারলে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। এমন কান্নায় কিছুটা বিব্রত লাগছিল। সঙ্গে করোনার এ সময়ে সামাজিক দূরত্ব না মানায় মনে মনে একটু বিরক্তও যে হইনি তা নয়। তাই তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে উপরে উঠতে চাইছিলাম। কী বলতে চান বলেন, এমন প্রশ্নের পাল্টা জবাবে লোকটি বললেন, একান্তে কথা বলতে চান। গেলাম অভ্যর্থনা স্থানের এক কোনায়, সোফার কাছে। খালিই ছিল সেখানটায়। এরপর শুরু করলেন এভাবে, ‘ভাই, আমি শেষ, আমাকে বাঁচান। শেয়ারবাজার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা…মিলে আমাকে শেষ করে দিয়েছে।’ কিছু নাম উল্লেখ করে ক্ষোভও ঝাড়লেন।

এক দিনেই তাঁর প্রায় পৌনে ৫ লাখ টাকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ৫ লাখ টাকার সেই শোকও হয়তো সহ্য করতে পারতেন আমিনুল। কিন্তু ঋণের জালে জড়িয়ে যাওয়ায় সেই শোক বইবার মতো শক্তি তাঁর অবশিষ্ট নেই।

 

এক যুগের বেশি সময় ধরে শেয়ারবাজার কাভার করছি। তাই এতটুকু শুনে বুঝতে আর বাকি রইল না, কেন এত ক্ষোভ। আর কী নিয়ে কথা বলতে এসেছেন ভদ্রলোক। বৃহস্পতিবার যখন উনার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন সময় বেলা তিনটার কাছাকাছি। দুপুর ১২টার পরপরই জেনে গেছি শেয়ারবাজারে ওই দিন বড় পতন হয়েছে। আর সেই পতনের পেছনে বড় কারণ ছিল কিছু কোম্পানির শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত। আগের দিন অর্থাৎ বুধবার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তালিকাভুক্ত ৬৬টি কোম্পানির শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বৃহস্পতিবার থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।

যেসব কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়, তার মধ্যে কয়েকটি ছাড়া বাকি সব কটিরই সর্বোচ্চ দরপতন ঘটেছে। আর তাতেই মতিঝিল থেকে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ছুটে এসেছেন বিনিয়োগকারী আমিনুল (ছদ্মনাম)। ওই বিনিয়োগকারীর অনুরোধে নামটি প্রকাশ করা হলো না। এক দিনেই তাঁর প্রায় পৌনে ৫ লাখ টাকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ৫ লাখ টাকার সেই শোকও হয়তো সহ্য করতে পারতেন আমিনুল। কিন্তু ঋণের জালে জড়িয়ে যাওয়ায় সেই শোক বইবার মতো শক্তি তাঁর অবশিষ্ট নেই।

 

আমিনুল জানান, ২০১০ সালের ধসে একবার শেয়ারবাজারে সব খুইয়েছেন। এরপর এক–দেড় বছর আগে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে আবারও শেয়ারবাজারে টাকা খাটিয়েছেন লাভের আশায়। ধার করে আনা টাকার বিপরীতে আবার নিয়েছেন প্রান্তিক বা মার্জিন ঋণ, তা–ও চড়া সুদে। আর সব অর্থ খাটিয়েছেন বস্ত্র খাতের একটি কোম্পানির শেয়ারে। ২০১৫ সালে তালিকাভুক্ত ওই কোম্পানির ৩ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার রয়েছে তাঁর পোর্টফোলিওতে। একসঙ্গে এত শেয়ার কেনেননি অবশ্য তিনি। কিনেছেন ধাপে ধাপে।

প্রথম কেনার পর থেকে একটু একটু করে কোম্পানিটির দাম কমেছে আর আমিনুল ধার ও ঋণের টাকায় ওই শেয়ার কিনেছেন ক্রয়মূল্য সমন্বয় করতে। কিনতে কিনতে ৩ লাখ ৩০ হাজার শেয়ার কিনেও তাঁর শেষ রক্ষা হলো না। এত দিন ওই শেয়ারে ফ্লোরপ্রাইস ছিল বলে আমিনুলের রক্ষা। ওই দামের নিচে নামার সুযোগ ছিল না বলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানও ঋণ আদায়ের জন্য চাপ দিতে পারেনি। কিন্তু বৃহস্পতিবার ফ্লোর প্রাইস ওঠে যাওয়ায় মাত্র ১০ হাজার শেয়ারের লেনদেনে আমিনুলের পোর্টফোলিওতে থাকা একমাত্র শেয়ারের দাম পড়ে যায় ১০ শতাংশ। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান আরও টাকা জমা দেওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছে। অন্যথায় আইন অনুযায়ী, বাধ্যতামূলক বিক্রি বা ফোর্সড সেলের আওতায় পড়বে আমিনুলের সব শেয়ার। তাতে আমিনুলকে শেয়ারবাজার থেকে আবারও ফিরতে হবে শূন্য হাতে।

টানা পতনের প্রতিবাদে ও বিএসইসির চেয়ারম্যান (সাবেক) এম খায়রুল হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে বিনিয়োগকারীরা ওই বিক্ষোভ করেছিলেন। সেই বিক্ষোভ ও টানা পতন থামাতে গত বছরের মার্চে শেয়ারের দামে সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বেঁধে দেওয়া হয়। যাতে ওই দামের নিচে নামতে না পারে কোনো শেয়ার। অভিনব সেই জোড়াতালির পন্থায় শেয়ারবাজারের পতন থামিয়েছিলেন খায়রুল হোসেন। তত দিনে অবশ্য বাজারের সূচক তলানিতে এসে ঠেকেছিল।

এই আশঙ্কা থেকেই এ প্রতিবেদককে পোর্টফোলিও দেখিয়ে শব্দ করেই কাঁদতে থাকেন মানুষটি। কথায় কথায় আমিনুল জানান, কষ্টের কথা জানাতে গিয়েছিলেন মতিঝিলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) অফিসে। ডিএসইর প্রধান কার্যালয় এখন সেখানে নেই। ডিএসইর মতিঝিল কার্যালয়ে ঢোকার অনুমতিই পাননি। যদিও সেখানে গিয়ে কতটা প্রতিকার পেতেন, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। উল্টো বিপদে যে পড়েননি তাতেই রক্ষা। কারণ, এর আগে পুঁজি হারিয়ে ডিএসইর সামনে বিক্ষোভ করায় বিনিয়োগকারীরা মামলার আসামি হয়েছেন। গ্রেপ্তারও হয়েছেন। সেটি খুব দূরের ইতিহাস না।

টানা পতনের প্রতিবাদে ও বিএসইসির চেয়ারম্যান (সাবেক) এম খায়রুল হোসেনের পদত্যাগের দাবিতে বিনিয়োগকারীরা ওই বিক্ষোভ করেছিলেন। সেই বিক্ষোভ ও টানা পতন থামাতে গত বছরের মার্চে শেয়ারের দামে সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বেঁধে দেওয়া হয়। যাতে ওই দামের নিচে নামতে না পারে কোনো শেয়ার। অভিনব সেই জোড়াতালির পন্থায় শেয়ারবাজারের পতন থামিয়েছিলেন খায়রুল হোসেন। তত দিনে অবশ্য বাজারের সূচক তলানিতে এসে ঠেকেছিল। খায়রুল হোসেনের সময়ে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে আসা শেয়ারে বিনিয়োগ করেছিলেন আমিনুল।

২০১১ সালে শেয়ারবাজারে ধসের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ।
২০১১ সালে শেয়ারবাজারে ধসের প্রতিবাদে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ। 

কোম্পানিটি আইপিওতে প্রতিটি শেয়ার ২০ টাকায় বিক্রি করেছিল। এখন সেই দাম নেমেছে ১৩ টাকায়। তাতেই আমিনুলের জীবন অসাড়। অবশ্য আমিনুলের ভুলও যে একেবারে নেই তা বলা যাবে না। প্রথম ভুল ধার করে টাকা এনে এবং সেই টাকার বিপরীতে আবারও ঋণ করে খাটিয়েছেন শেয়ারবাজারে। অথচ শেয়ারবাজার কখনো ঋণ করে বিনিয়োগ করার বাজার নয়। তাঁর দ্বিতীয় ভুল সব অর্থ বিনিয়োগ করেছেন একটিমাত্র শেয়ারে। অথচ বারবারই বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিনিয়োগের সব অর্থ এক শেয়ারের না খাটানোর জন্য। পত্রিকায়ও বছরের পর বছর সেই পরামর্শ ছাপা হয়। আমিনুলকে প্রশ্ন করলাম, এই যে সব হারিয়ে এখন প্রতিকারের জন্য পত্রিকা অফিসে এলেন, পত্রিকায় লেখা পরামর্শ তো মানেন না, শোনেন না। জবাব দিতে পারেন না তিনি। নিচু স্বরে বলেন, ভুল হয়ে গেছে।

হঠাৎ করে হাতে গোনা কিছু কোম্পানির মূল্যস্তর তুলে নেওয়ার কারণে বিপদে পড়েছে অনেক বিনিয়োগকারী। অবশ্য মূল্যস্তর কখনো শেয়ারবাজারের পতন রোধের পন্থাও হতে পারে না। এটি ছিল একটি সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র। বিএসইসি কিছু কোম্পানির ওপর থেকে এ মূল্যস্তর তুলে নিয়েছে মূলত বাজারে লেনদেন বাড়াতে। যদিও সংস্থাটি সরাসরি সেটি স্বীকার করেনি। তবে বাজারসংশ্লিষ্ট কারও পক্ষে সেটি বোঝা খুব কষ্টের কোনো কাজ নয়। মূল্যস্তর তোলার জন্য বিএসইসি এমন সব কোম্পানিকে বেছে নিয়েছে, বাজারের সূচকের ওপর যেগুলোর খুব বেশি প্রভাব নেই।

বিএসইসি ভেবেছিল, এগুলোর দাম যদি কমেও অন্য শেয়ারের দাম বাড়লে তাতে সূচকে কোনো প্রভাব পড়বে না। উল্টো শেয়ারগুলো লেনদেনযোগ্য হলে তাতে বাজারে লেনদেন বাড়বে। ১১০টির মতো কোম্পানির শেয়ার অনেক দিন ধরেই ফ্লোর প্রাইসে আটকে ছিল। সেখান থেকেই সূচকে প্রভাব নেই এমন ৬৬টির ওপর থেকে তাই ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পরীক্ষামূলক নিরীক্ষাটি চালানো হয়। সূচকে এসব কোম্পানির প্রভাব না থাকলেও বিএসইসির কৌশলী পন্থায় শেষ রক্ষা হয়নি সূচকের।

আসলে আমাদের শেয়ারবাজারের সমস্যাটা ফ্লোর প্রাইসে নয়। সমস্যাটি বরাবরই আস্থা ও সুশাসনের ঘাটতির। তাই ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার খবরে ভালোমন্দ বাছবিচার ছাড়া বেশির ভাগ শেয়ারের দাম পড়ে যায়। আবার তার বিপরীতে বিমা খাতের কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। বেশ কিছুদিন ধরেই এ খাতের কিছু শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে এমনটি জানা নেই।

কারসাজিকারকদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে যেন বরাবরই বিএসইসির ধীরে চলো নীতি। পাছে বাজার যদি পড়ে যায়। তাই এ বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষণে আসে, ক্ষণে যায়। আর সেই ঠুনকো আস্থার বাতাসে দুলতে থাকে আমাদের শেয়ারবাজার। কারসাজিকারকেরা সেই বাতাসে নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখে ধুলো ছিটিয়ে টাকা কুড়ান। তাতেই কাঁদতে কাঁদতে এই দোয়ার ওই দোয়ারে ঘুরতে হয় আমিনুলদের।

"Fenionline 24" radio station keep update bangla songs every day. Thanks for Visit our "feni online" 24 radio station website.